জার্মানিতে নিষিদ্ধ হতে পারে এএফডি পার্টি

উগ্র ডানপন্থিরা এখন ইউরোপের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে। এর মধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছে অলটারনেটিভ ফর জার্মানি বা এএফডি পার্টির নাম। জার্মানিতে ডিসেম্বরে ফেডারেল নির্বাচন হলে দলটি ২১ শতাংশ ভোট পেত বলে জনমত জরিপে দেখা গেছে। মধ্য ডানপন্থি ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিডিইউ/সিএসইউ) জোট পেত ২৭ শতাংশ ভোট। এদের পরই জোরালোভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকত এএফডি। এদিকে চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজের নেতৃত্বাধীন মধ্য বামপন্থি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এসপিডি) জনপ্রিয়তায় নেমেছে ধস। তাদের জনপ্রিয়তা ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশে নেমে গেছে।

জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্ক ওয়াল্টার স্টেইনমিয়ের সম্প্রতি বলেছেন, ‘যারা গণতন্ত্রকে রুদ্ধ করতে চায় তাদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ আমাদের জন্য খোলা আছে।’ দেশটির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার উদ্দেশে তিনি কথাগুলো বলেছেন। গোয়েন্দা প্রধান টমাস হ্যাল্ডেন ওয়াং বলেন, এএফডির মধ্যে চরমপন্থিদের প্রভাব বাড়ছে। পূর্বাঞ্চলীয় থুরিঞ্জিয়া রাজ্যে এএফডি পার্টির প্রভাব এখন এতটা যে কর্তৃপক্ষকে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে। পার্টির প্রধান বিজরন হকে সেখানকারই বাসিন্দা। হকে পেশায় ছিলেন একজন ইতিহাসের শিক্ষক। কিন্তু তিনি এখন কট্টরপন্থি বনে গেছেন। আগস্টে মাগডেবুর্গে অনুষ্ঠিত পার্টি সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ইউরোপজুড়ে তারা এখন প্রাধান্য বিস্তার করতে চলেছেন। 

জার্মানির বহুল প্রচারিত ডার স্পাইগেল সমায়িকীতেও এএফডির বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সাময়িকীর এক প্রচ্ছদ কাহিনিতে হকের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে ‘সংবিধানের শত্রুদের রুখে দিন’। ক্ষমতাসীন এসপিডির অনেক নেতাই এখন বলছেন যে এএফডির ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার। তবে সিডিইউর নেতা ফ্রেডারিখ মার্জ বলেছেন, দল নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করা যায় না। এএফডির তৎপরতা যে পর্যায়ে গেছে তাতে সে দেশের অনেকেই উদ্বিগ্ন। বেসরকারি সংস্থা জার্মান ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে, এএফডি বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে। সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই একে নিষিদ্ধ করা সম্ভব। তারা জার্মানির সমাজ ও রাজনীতির ধারা বদলে দিতে পারে।

জার্মানিতে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ কোনো নতুন বিষয় নয়। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে। দেশটির প্রথম চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্ক সম্রাট কাইজারের (কধরংবৎ) প্রতি আনুগত্য না দেখানোর জন্য সোশ্যালিস্ট ডেমোক্র্যাটদের নিষিদ্ধ করেছিলেন। নাৎসিরা ক্ষমতায় এসে বাকি সব দল নিষিদ্ধ করে। পূর্ব জার্মানিতে জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক এক সময় নিষিদ্ধ হয়েছিল ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির সহযোগী না হওয়ার জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মান সংবিধানে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা কঠিন করা হয়েছে। এ কারণে নিও নাজি এনপিডি দলকে নিষিদ্ধ করা যায়নি। দলটি নিষিদ্ধ করার জন্য ২০০৩ এবং ২০১৭ সালে উদ্যোগ নেওয়া হলেও উচ্চ আদালত দুইবারই সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভোলকার বোয়েহমে নেসলার মনে করেন, নিষিদ্ধ হওয়ার মতো উপযুক্ত কারণ থাকলে কেবল আইনের আশ্রয় নিয়ে একটি দল এ থেকে রেহাই পেতে পারে না। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে না পারলে সেটা এএফডির আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে, জার্মান গণমাধ্যম এমডিআরকে তিনি কথাগুলো বলেন। তিনি উল্লেখ করেন, যে দল নির্বাচনে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ভোট পায় তাকে নিষিদ্ধ করা যায় না। 

এএফডিকে নিষিদ্ধ করার ইস্যুতে জার্মান জনমত পুরোপুরি দ্বিধাবিভক্ত। এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশ মানুষ চায় দলটি নিষিদ্ধ করা হোক, আবার নিষিদ্ধ না করার পক্ষেও আছে ৪৭ শতাংশের সায়। জনমত একেবারে সমান সমান দ্বিধাবিভক্ত। তবে সেটা ৫০ শতাংশের চেয়ে কম।

ইউরোপ জুড়েই এখন উগ্র ডানপন্থিদের রমরমা অবস্থা। ৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপ ও সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলো থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের লোকজনের পশ্চিমমুখী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। এরপর ইরাক ও আফগান যুদ্ধ, আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ ও আরব বসন্তের ফলে বহু লোক ইউরোপ ও আমেরিকায় দেশান্তরী হয়েছে। সোভিয়েত আমল থেকেই কম্যুনিস্ট দেশগুলো থেকে অনেকে পশ্চিমা দেশে অভিবাসী হয়েছে। এই ঘটনাগুলোই মূলত উগ্র ডানপন্থার সূচনায় ভূমিকা পালন করেছে। পশ্চিমা উগ্রপন্থিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য তারা অভিবাসী ও মুসলিমবিরোধী। বর্তমানে অভিবাসীদের অধিকাংশই মুসলিম। জার্মানিতে কেবল ২০১৫ সালেই ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসী আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া ডানপন্থিদের বিশেষভাবে চাঙ্গা করে। ট্রাম্প এখন ক্ষমতায় নেই, কিন্তু তিনি যে মতবাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন, যাকে অনেকে ‘ট্রাম্পিজম’ বলে পশ্চিমা দেশগুলোতে তার সমর্থকের সংখ্যা একেবারে কম নয়। জনমত জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনে দুই জন মনে করে আগামী এক দশকের মধ্যে সেদেশে ডানপন্থিদের শাসন ফিরতে পারে। 

অস্ট্রিয়ার উগ্র ডানপন্থি ফ্রিডম পার্টির (এফপিও) নেতা জর্গ হেইডার কিছুদিন আগে প্রকাশ্যে জার্মানির সাবেক নাৎসি দলের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় কেবল রাজধানী ভিয়েনাতেই নয়, ইউরোপের বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ হয়েছে। এফপিও রক্ষণশীল পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটের একটি শরিক দল। ২০১৭ সাল থেকে দলটি সরকারের সঙ্গে আছে। এরপর তারা বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনেও ভালো ফল করেছে। এফপিওর চাপেই ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টি অভিবাসীদের প্রতি কঠোর নীতি অবলম্বন করেছে। এ কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ভিয়েনার ওপর কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইউরোপের একটি ভয়াবহ রক্তাক্ত ইতিহাস রয়েছে। তাই কোনো দল ডানপন্থি হলেও ওই সীমা অতিক্রিম করতে পারে না। 

স্পেনে ২০১৯ সালের নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থি ভোক্স পার্টি তৃতীয় শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। যদিও ধারণা করা হচ্ছিল, ২০১১ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর দেশটিতে ডানপন্থিরা সুবিধা করতে পারবে না। ভোক্স যেমন অভিবাসীবিরোধী, একই সঙ্গে দলটি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনেরও বিরোধী। ফ্রান্সে মেরি লিপেনের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল র‌্যালি পার্টি এগিয়ে চলেছে। গত বছর পার্লামেন্ট নির্বাচনে তারা আশাতীত ভালো করে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ডানপন্থি ব্রাদার্স অব ইতালি পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। হাঙ্গেরি, সুইডেনেও ডানপন্থিরা ক্রমাগত জনসমর্থন বাড়িয়ে চলেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //